মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস PDF

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস PDF

 

--অন্ধকার যুগ (১২০১-১৩৫০)----


বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মধ্যযুগ। প্রথম ১৫০ বছর অন্ধকার যুগ; সাহিত্যের কোনো উল্লেখযোগ্য নিদর্শন না পাওয়ায় ঐতিহাসিকগণ এ সময়কে বাংলা সাহিত্যের ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। 


রামাই পন্ডিত রচিত ‘শুণ্যপুরাণ’ গদ্য-পদ্য মিশ্রিত চম্পুকাব্য। ‘নিরঞ্জনের উষ্মা’ শুন্যপুরাণ কাব্যের একটি বিখ্যাত কবিতা। কবিতাটি ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে রচিত। 

হলায়ুধ মিশ্র রচিত সংস্কৃত গদ্যপদ্যে রচিত চস্পুকাব্য ‘সেক শুভোদয়া’। ‘সেক শুভোদয়ায়’ রাজা লক্ষèণ সেন ও শেখ জালানুদ্দীন তাবরেজির অলৌকিক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। হলায়ুধ মিশ্র রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি ছিলেন। 



মধ্যযুগের কাব্যধারা চারটি ধারায় প্রবাহিত: 

(১) মঙ্গল কাব্য (২) অনুবাদ সাহিত্য 

(৩) রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ও (৪) বৈষ্ণব পদাবলী। 


মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শাখা-প্রশাখাগুলো হচ্ছে- 

(ক) শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য (খ) মঙ্গলকাব্য 

(গ) অনুবাদ সাহিত্য (ঘ) বৈষ্ণব পদাবলী 

(ঙ) জীবনী সাহিত্য (চ) নাথ সাহিত্য 

(ছ) মর্সিয়া সাহিত্য (জ) দোভাষী পুঁথি 

(ঝ) রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ও (ঞ) লোক সাহিত্য। 

-- --শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য----

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য মধ্যযুগের প্রথম কাব্য। এ কাব্যের রচয়িতা বড়ু চন্ডীদাস। ভাবগত পুরাণের কৃষ্ণলীলা সম্পর্কিত কাহিনী অবলম্বনে লোকসমাজে প্রচলিত রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনীকে অবলম্বন করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কাহিনী গড়ে উঠেছে। বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে (বাংলা ১৩১৬) পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের মল্লরাজ গুরু বৈষ্ণব মহন্ত শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র বংশজাত শ্রী দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির গোয়ালঘর থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুঁথি আবিস্কার করেন। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায়ের সম্পাদনায় ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের প্রকৃত নাম ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ। 

বসন্তরঞ্জন রায়ের উপাধি ছিল ‘বিদ্বদ্বল্লভ’। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামটি প্রদান করেন সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কবি বড় ু চÐীদাস। রচনাকালের দিক থেকে বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় গ্রন্থ হল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। এর রচনাকাল চতুর্দশ শতক। এটি নাট-গীত (গীতি-নাট্য) ভঙ্গিতে তের খÐে রচিত। সমস্ত কাব্যে মোট তিনটি চরিত্র আছে- রাধা, কৃষ্ণ ও বড়ায়ি। কাব্যটির বিষয়বস্তু হল রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমলীলা। মর্তবাসী রাধা ও কৃষ্ণের প্রকৃত পরিচয় বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষীদেবী ও বিষ্ণু। কৃষ্ণ ও রাধার আকর্ষণীয় প্রণয়কাহিনী সম্বলিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে নরনারীর প্রণয় সম্পর্কের ওপরে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তৎকালীন সমাজের বাস্তব চিত্রও এতে ফুটে ওঠেছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন দেহবাদী রগরগে প্রেমের কাহিনী। এ কাব্যে প্রথমে যে রাধাকে দেখানো হয় তিনি প্রেমের তাৎপর্য বুঝেন না। বড়ায়ির সহায়তায় নানা ছল করে কৃষ্ণ কীভাবে রাধার সাথে দৈহিক মিলনের স্বাদ নিলেন এ কাব্যে তা বিশদ বর্ণিত হয়েছে। মিলনের পর কৃষ্ণ রাধার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে এবং কাজের ছুতায় অন্যত্র গমন করে। রাধার চরম বিরহের মধ্য দিয়ে এ কাব্যের পরিসমাপ্তি। রাধার তীব্র বিরহ এ কাব্যে দরদের সাথে অঙ্কিত হয়েছে। 

মধ্যযুগে পুঁথিগুলো নকল হওয়ার সময় ভাষার পরিবর্তন ঘটলেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে পুরানো বাংলার লক্ষণ রয়ে গেছে। ধারণা করা হয়, এ কাব্য জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছিল এবং লোকমুখে জনপ্রিয় ছিল না। বড়ু চন্ডীদাস এ কাব্য রচনা করেছিলেন চৈতন্যদেবের আগে। চৈতন্যদেব বৈষ্ণব দর্শনের নতুন ব্যাখ্যা দেয়ার পর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের দেহবাদী কাহিনী আর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারে নি। ফলে এ কাব্য বন্দী হয় পুঁথির পাতায়। 

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহের মতে চন্ডীদাস তিন জন- 

(১) বড়ু চন্ডীদাস; (২) দ্বিজ চন্ডীদাস ও (৩) দীন চন্ডীদাস। 

বড়ু চন্ডীদাস চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগের, দ্বিজ চন্ডীদাস চৈতন্য যুগের এবং দীন চন্ডীদাস চৈতন্য পরবর্তী যুগের কবি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বড়ু চন্ডীদাস বাসুলী দেবীর ভক্ত। 

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের একটি লাইন- 

‘কে না বাঁশী বা এ বড়ায়ি কালিনী নইকুলে’ 


-- --মঙ্গল কাব্য----

মঙ্গল কাব্য- ধর্মবিষয়ক আখ্যান কাব্য নামে খ্যাত। খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এসব মঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছে। অনেকের মতে এক মঙ্গলবার থেকে পরবর্তী মঙ্গলবার পর্যন্ত পালাকারে গতি হতো বলে এর নাম মঙ্গলকাব্য। মঙ্গলকাব্যের প্রধান দুই দেবী হচ্ছেন মনসা ও চন্ডী। 

মঙ্গলকাব্যগুলো গীত হতো পূজানুষ্ঠানের অঙ্গ হিসাবে। প্রতিটি কাব্য নির্দিষ্ট সংখ্যক পালায় বিভক্ত- মনসামঙ্গল ৩০ পালায়, চন্ডীমঙ্গল ১৬ পালায়। 

মঙ্গলকাব্য দু’ শ্রেণিতে বিভক্ত- 

(১) পৌরাণিক মঙ্গলকাব্য; 

(২) লৌকিক মঙ্গলকাব্য। লৌকিক মঙ্গলকাব্যে বণিক ও নিন্মবর্ণেও মানুষের প্রাধান্য দেখা যায়। 

মঙ্গলকাব্যের প্রথম যুগের ভাষা স্থল ও গ্রাম্যতাপূর্ণ, মধ্যযুগের ভাষা সহজ ও সাবলীল এবং শেষ যুগের ভাষা অলঙ্কারসমৃদ্ধ। 

-- --মনসামঙ্গল কাব্য----

সর্পসংকুল ভারতবর্ষে নানা মূর্তিতে সাপের পূজা হয়- উত্তর ভারতে সরীসৃপ মূর্তির, দক্ষিণ ভারতে জীবিত সর্পের পূজা হয়। পূর্বভারতে তথা বঙ্গদেশে মনসার ঘটের পূজা করা হয়। উত্তর ভারতে সাপের দেবতা বাসুকী পুরুষ বঙ্গদেশে মনসা নারী। মনসামঙ্গল কাব্য মঙ্গল কাব্যের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন মঙ্গলকাব্য। মনসামঙ্গল কাব্যের নাম চরিত্র লৌকিক দেবী-সর্পদেবী মনসা। মনসা দেবীর অন্য নাম- কেতকা ও পদ্মাবতী। মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান প্রধান চরিত্র- দেবী মনসা, চাঁদ সওদাগর, সনকা, বেহুলা ও লখিন্দর। 

-- --মনসামঙ্গল কাব্যের কবি ---

মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি কানা হরিদত্ত। তার পুঁথি পাওয়া যায় নি। বিজয়গুপ্ত হরিদত্তকে মূর্খ ও ছন্দোজ্ঞানহীন বলে উল্লেখ করেছেন। তবে মনসা কাহিনীর যে কাঠামো তিনি সৃষ্টি করেছেন তা কয়েক শত বছর ধরে অনুসৃত হয়েছে, এটি তার মৌলিকতার পরিচয়। 

সুস্পষ্ট সন তারিখযুক্ত মনসামঙ্গল কাব্যের প্রথম রচয়িতা কবি বিজয়গুপ্ত। তার কাব্যের নাম পদ্মপুরাণ। কবি বিজয়গুপ্ত বরিশাল জেলার গৈলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গৈলা গ্রামের প্রাচীন নাম ফুল্লশ্রী। কবি বিজয়গুপ্ত সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের শাসনামলে ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে কাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হন। তার কাব্যের ব্যপক প্রচার হয়েছিল। 

মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি নারায়ণদেব। বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার বোরগ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নারায়ণ দেব পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগের কবি। তার কাব্যের নাম ‘পদ্মপুরাণ’ পদ্মপুরাণের একটি চরণ- 

“সিবলিঙ্গ আমি পূঁজি জেই হাতে 

সেই হাতে তোমারে পূজিতে না লয় চিত্তে”। 

কবি বিপ্রদাস পিপিলাই ১৪৯৫ সালে ‘মনসাবিজয়’ কাব্য  রচনা করেন। চব্বিশ পরগণা জেলার নদুড়্যা চট্টগ্রাম (পাঠান্তরে বাদুড্যা) ছিল বিপ্রদাসের নিবাস। তার পিতা মুকুন্দ পন্ডিত। 

বিজয় বংশীদাস রচিত মঙ্গলকাব্যের নাম ‘পদ্মপুরাণ’। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিজ বংশীদাস কবি চন্দ্রাবতীর পিতা। চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি। কবি দ্বিজ বংশীদাস সুকণ্ঠ গায়ক হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন এবং বাড়িতে টোল চালাতেন। 


আরেক জনপ্রিয় কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ পশ্চিমবঙ্গের কবি। জনপ্রিয়তায় শ্রেষ্ঠ কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ-এর মূল নাম ক্ষেমানন্দ এবং কেতকাদাস তার উপাধি। কেতকা দেবী মনসার অপর নাম। কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ দেবীকর্তৃক আদিষ্ট হয়ে কাব্য রচনা করেছেন। কবি ক্ষেমানন্দের কাব্যে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গ ও রামায়ণ কাহিনীর প্রভাব রয়েছে। 

দেবনাগরী অক্ষরে ও আঞ্চলিক শব্দে লিখিত আর ও একটি পুঁথি আবিস্কৃত হয়েছে যার রচয়িতা ক্ষেমানন্দ নামে আরেক স্বতন্ত্র কবি। 

বাইশা: বাইশা কবির পদসংকলন বা ‘বাইশ কবির মনসামঙ্গল’ বা বাইশ কবির মনসা বা বাইশা নামে খ্যাত। 

মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রতিবাদী চাঁদ সওদাগর। চাঁদ সওদাগরের স্ত্রীর নাম সনকা। চাঁদ সওদাগরের চৌদ্দ ডিঙ্গা মনসা ডুবিয়ে দিয়েছিল এবং ছয় পুত্রকে মেরে ফেলেছিল। 

বেহুলা স্বর্গের দেবতাদের নামে গানে সন্তুষ্ট করলে মৃত স্বামী লখিন্দরের জীবন ফিরে পায়। চাঁদ সওদাগর অন্যদিকে ফিরে বাম হাতে মনসার মূর্তিতে ফুল ছুড়ে দিলে পৃথিবীতে মনসার পূজা প্রচলিত হয়। 

বিস্তারিত জানতে পিডিএফটি সরাসরি ডাউনলোড করুন: 

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস PDF ( সরাসরি গুগল ড্রাইভ)

অন্যান্য পিডিএফ লেকচারের লিংক:

ইতিহাসের বিভিন্ন যুদ্ধ PDF

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস PDF

বি:দ্র: আমাদের দেওয়া কোন পিডিএফ সম্পর্কে কোন অভিযোগ, মতামত থাকলে অবশ্যই আমাদেরকে কমেন্ট করবেন। 




Post a Comment (0)
Previous Post Next Post