শায়ের ও কবিওয়ালা.
আঠারো শতকের শেষার্ধে এবং উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতার হিন্দু সমাজে ‘কবিওয়ালা’ এবং মুসলমান সমাজে ‘শায়ের’-এর উদ্ভব ঘটে। এ কবিয়াল ও শায়েররা যে সাহিত্য রচনা করেছে তাকে দোভাষী সাহিত্য বলে।
রামনিধি গুপ্ত (নিধুবাবু) বাংলা টপ্পা গানের জনক। তার রচিত অমর পঙক্তি হল-
নানান দেশের নানান ভাষা
বিনা স্বদেশী ভাষা
পুরে কি আশা।
কবি এন্টনি ফিরিঙ্গি হলেন পর্তুগিজ খ্রিষ্টান। তিনিও বাংলার কবি হয়েছিলেন, তবে তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফিরিঙ্গি শব্দটি।
পুঁথি সাহিত্য.
শায়েররা যে সাহিত্য রচনা করেছে তাকে দোভাষী পুঁথি সাহিত্য বলে। দোভাষী পুঁথি সাহিত্য বাংলা, ফারসি, আরবি, হিন্দি, ইংরেজি, প্রভৃতি ভাষার শব্দ ব্যবহার করে মিশ্র ভাষায় রচিত। এটি কলকাতার সস্তা প্রেস থেকে ছাড়া হতো বলে এটি বটতলার পুঁথি বলা হয়।
‘শায়ের’-দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ফকির গরীবুল্লাহ, সৈয়দ হামজা, মোহাম্মদ দানেশ।
ফকির গরীবুল্লাহ দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের প্রথম সার্থক ও জনপ্রিয় কবি। তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হলো জঙ্গনামা, আমীর হামজা, সোনাভান। জঙ্গনামা কাব্যের বিষয় যুদ্ধ বিগ্রহ।
পুঁথি সাহিত্যের প্রাচীনতম কবি হলেন সৈয়দ হামজা। কবি সৈয়দ হামজা রচিত গ্রন্থ হলো ‘মধুমালতী’, জৈগুনের পুঁথি’, হাতেম তাই’।
নাথ সাহিত্য/শাক্ত পদাবলী.
বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে নাথ ধর্মের কাহিনী অবলম্বনে রচিত আখ্যায়িকা কাব্য নাথ সাহিত্য নামে পরিচিত। নাথ সাহিত্য ব্যালাড বা গীতিকথা হিসেবেও পরিচিত। এ সাহিত্য লোক সাহিত্যধর্মী এবং শিল্প সাহিত্যধর্মী রচনা ছিল না।
আদিনাথ শিব, মীননাথ, হাড়িপা, কানুপা- এই চারজন সিদ্ধাচার্যের মাহাত্ম্যসূচক অলৌকিক কাহিনী অবলম্বনে নাথ সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। নাথ সাহিত্যে আদিনাথ শিব, পার্বতী, মীননাথ, গোরক্ষনাথ, হাড়িপা, কানুপা, ময়নামতি ও গোপীচন্দ্রের আখ্যান প্রভৃতি সাহিত্যিক নিদর্শন হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে জর্জ গিয়ার্সন রংপুর থেকে সংগৃহীত একটি গীতিকা ‘মানিক রাজার গান’ নামে প্রকাশ করেন। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ শেখ ফয়জুল্লাহর ‘গোরক্ষবিজয়’ আবিষ্কার করেন। গোরক্ষনাথের মহিমা কাহিনী এবং ময়নামতী ও গোপীচন্দ্রের আখ্যান নাথ সাহিত্যের সাহিত্যিক নিদর্শন হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
নাথ সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি হলেন শেখ ফয়জুল্লাহ, শ্যামদাস সেন, ভীম সেন, ভবানী দাস, শুকুর মুহম্মদ, দুর্লভ মল্লিক।
শেখ ফয়জুল্লাহ.
ষোল শতকের কবি শেখ ফয়জুল্লাহ হলেন নাথ সাহিত্যের সুবিখ্যাত কবি। তার প্রধান কাব্যগ্রন্থ হল ‘গোরক্ষবিজয়’। ‘ভারত প্যাঁচালী’ রচয়িতা কবীন্দ্র দাসের মুখে গল্প শুনে কবি ফয়জুল্লাহ তার কাব্যটি রচনা করেন। এটি সংগ্রহ ও সম্পাদনা করেছেন আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। এছাড়াও তিনি গাজীবিজয়, সত্যপীর প্যাঁচালী, জয়নাবের চৌতিশা ইত্যাদি কাব্য রচনা করেন।
কবি সাহিত্যকর্ম
শেখ ফয়জুল্লাহ গোরক্ষবিজয়
শ্যামদাস সেন মীনচেতন
ভীমসেন রায় গোরক্ষ বিজয়
ভবানী দাস ময়নামতির গান
শুকুর মাহমুদ গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস
মর্সিয়া সাহিত্য .
মর্সিয়া শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ শোক প্রকাশ করা। প্রধানত কারবালার প্রান্তরে শহিদ ইমাম হোসেন (রা) ও অন্যান্য শহিদদের উপজীব্য করে লেখা সাহিত্য হল মর্সিয়া সাহিত্য। মুঘল আমলে যে সব কবি মর্সিয়া সাহিত্য রচনা করেছেন তারা হলেন শেখ ফয়জুল্লাহ, দৌলত উজির বাহরাম খান, মুহম্মদ খান, হায়াৎ মামুদ, জাফর হামিদ প্রমুখ।
মর্সিয়া সাহিত্যের আদি কবি শেখ ফয়জুল্লাহকে মনে করা হয়। তিনি ‘জয়নবের চৌতিশা’ নামকক গ্রন্থটি রচনা করেন।
মুহম্মদ খান রচিত গ্রন্থের নাম ‘মুক্তুল হোসেন’। এই কাব্যগ্রন্থটি ফারসি ‘মক্তুল হোসেন’ কাব্যের ভাবানুবাদ।
হায়াৎ মামুদ অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত কবি। তার রচিত ‘জঙ্গনামা’ কাব্যটি ফারসি কাব্যের অনুসরণে রচিত।
মর্সিয়া ধারার হিন্দু কবি হলেন রাধারমণ গোপ। তিনি ‘ইমামগণের কেচ্ছা’ ও ‘আফৎনামা’ নামে দুটি কাব্য রচনা করেন।
উপকথা, লোকগীতি, রূপকথা, ছড়া একশ্রেণির আখ্যানমূলক লোকগীতি বাংলাসাহিত্য ‘গীতিকথা’ নামে অভিহিত। ইংরেজিতে একে বলা হয় ‘ব্যালাড’ বাংলাদেশের সংগৃহীত গীতিকা তিন ধরনের- নাথ গীতিকথা ও ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা, ময়মনসিংহ গীতিকা।
নাথ গীতিকা এক ধরনের ঐতিহাসিক রচনা। স্যার জর্জ গ্রিয়ার্সন ১৮৭৮ সালে রংপুর জেলার কৃষকদের নিকট থেকে এগুলো সংগ্রহ করে নাম দেন ‘মানিক রাজার গান’। ময়নামতীর গান, মানিক রাজার গীত বা গোপীচাঁদের সন্ন্যাস নাথ গীতিকার উদাহরণ।
ময়মনসিংহ গীতিকা ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাংশে ময়মনসিংহের বিল হাওর নদীঅঞ্চলের লোককবিগণের রচনা। চন্দ্র কুমার দে ময়মনসিংহ গীতিকার পালাগানগুলোর সংগ্রাহক। এর কাহিনীগুলো হল- মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারামের পালা, রূপবতী, কঙ্ক ও লীলা, কাজলরেখা, দেওয়ানা মদিনা।
মনসুর বয়াতি রচিত ‘দেওয়ানা মদিনা’ পালাটি ময়মনসিংহ গীতিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসাবে সমাদৃত। বানিয়াচঙ্গের দেওয়ান সোনাফরের পুত্র আলাল ও দুলালের বিচিত্র জীবন কাহিনী এবং দুলাল ও গৃহস্থকন্যা মদিনার প্রেমকাহিনী দেওয়ানা মদিনার বিষয়বস্তু।
গীতিকাগুলোর মধ্যে মহুয়া পালাটিতে ময়মনসিংহ গীতিকার বৈশিষ্ট্য চমৎকারভাবে ফুটে উটে। পালাটির রচয়িতা দ্বিজ কানাই, সংগ্রহ ও বর্ণনা করেছেন পল্লিকবি জসীমউদদীন।
গদ্যের মাধ্যমে কাহিনী বর্ণিত হলে তাকে লোককথা বা লোককাহিনী বলে। ইংরেজিতে একে বলে ঋড়ষশ ষড়ৎব.
রূপকথায নানা অবাস্তব ও অবিশ্বাস্য ঘটনা ভীড় করে। বাস্তব রাজ্যের সাথে এর সম্পর্ক নেই। ইংরেজিতে রূপকথাকে বলে ঋধরৎু ঞধষবং. দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের সংগ্রহের রূপকথার নাম ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুররি রূপকথা সংগ্রহের নাম ‘টুনটুনির বই’।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কয়েকজন পৃষ্ঠপোষক .
রুকুনউদ্দিন বরবক শাহের আমলে কবি মালধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ লিখতে শুরু করেন। তার পুত্র শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ মালধর বসুকে ‘গুণরাজ খান’ উপাধি দেন।
বিজয়পÐিত ইলিয়াস শাহী শাসনামলে মহাভারত রচনা করেন।
হুসেন শাহের রাজদরবারে খ্যাতনামা কবিগণ হলেন মালাধর বসু, বিপ্রদাস, বিজয়গুপ্ত, যশোরাজ প্রমুখ। বরিশালের কবি বিজয়গুপ্ত সুলতান হুসেন শাহের আমলে রচনা করেন ‘পদ্মপুরাণ’। হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খানের পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রামের কবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর বাংলায় মহাভারত অনুবাদ করেন। কবি শ্রীধর ফিরোজ শাহের আমলে ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন।